পঞ্চম শিল্প বিপ্লব: প্রযুক্তি এবং প্রকৃতি

বর্তমান বিশ্ব যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই উঠে আসে আরেকটি শিল্প বিপ্লবের কথা। পঞ্চম শিল্প বিপ্লব।
শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখেছে, নিজেদের চিন্তাশক্তির দ্বারা ভবিষ্যতের স্বার্থে এবং বর্তমানের প্রয়োজনে জীবনব্যবস্থাকে বারবার পুননির্মিত করেছে।
আঠারো শতাব্দীতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানুষ কৃষি যুগ থেকে বের হয়ে আসে। স্থাপিত হয় প্রথম শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকটা সময় পর বিংশ শতাব্দীতে এসে আবিষ্কৃত হয় বিদ্যুৎ। শুরু হয় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের যুগ। বিদ্যুৎনির্ভর শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে গণউৎপাদন, এসেম্বলী লাইন এবং বিদ্যুৎনির্ভর প্রযুক্তির ব্যপক সম্পর্ক ছিল।
মাইক্রোপ্রসেসর, সেমিকন্ডাক্টর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব কর্মক্ষেত্রকে ব্যক্তিগত কম্পিউটারের সাথে পুরোপুরি সংযোগ স্থাপন করে দিয়েছিল।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মূলত প্রযুক্তির বিপ্লব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব স্মার্ট প্রযুক্তি এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির যান্ত্রিক মিশেলে মানুষের জীবনযাত্রার মানকে সহজ এবং উন্নত করার পাশাপাশি পুরোটাই যান্ত্রিক নির্ভর করে ফেলছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এতটাই যান্ত্রিক যে, তা মানুষের জন্যে বিপদজনক হতে পারে। মানুষের কর্মচ্যুতির পাশাপাশি প্রযুক্তির দাপট এমনভাবে সম্প্রসারিত হতে পারে যে, সভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষ একটু থমকে দাঁড়াতেই পারে। আমাদের মতো, ভারতের মতো বা চীনের মতো জনবহুল দেশগুলোর জন্যে রোবট ব্যবহার করে মানুষের কর্মসংস্থান বিনষ্ট করাটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। চালকবিহীন গাড়ি জাপানের জন্যে খুবই চমৎকার হতে পারে, জার্মানি পোশাক বানানোর রোবট নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হতে পারে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা ভাবলে গা শিউরে উঠবে। এমনিতেই তারা কর্মসংস্থানের সংকটে নিমজ্জিত, এর মাঝে ডিজিটাল প্রযুক্তি যদি মানুষকে কর্মহীন করে দেয় তবে রক্ষা নেই।
মূলত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যান্ত্রিকতার আগ্রাসন থেকে সরে এসে, মানুষ এবং যন্ত্রের সহাবস্থান তৈরি করার উদ্দেশ্যেই পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা ভাবা হচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম পঞ্চম শিল্প বিপ্লবকে মানবিক বলছে। পঞ্চম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষের জন্যে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের ধারনা বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞদের কাছে এখনো এতটাই নতুন যে উনারা এটাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন।
ভবিষ্যতদ্বাণী জর্জ মুইর যুক্তি দেন যে, এটি এআই ( আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) বিপ্লব হবে।
এমইপি ইভা কাইলি মনে করেন যে, এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ করবে।
তবে সেলসফোরের প্রতিষ্ঠাতা এবং সহ-প্রধান নির্বাহী মার্ক বেনিফের পঞ্চম শিল্প বিপ্লব প্রসঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামকে বলেন, আমি প্রযুক্তিতে বিশ্বাসের সংকট দেখতে পাচ্ছি এবং পঞ্চম শিল্প বিপ্লব শিল্প কৌশলে প্রযুক্তির নৈতিক ও মানবিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
পঞ্চম শিল্প বিপ্লব নিয়ে গবেষকদের সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য বক্তব্যটি হচ্ছে, এটি হবে পৃথিবীর জন্যে এবং মানুষের জন্যে প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগ।
প্রথমত পঞ্চম শিল্প বিপ্লব এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পাশাপাশি সমান্তরালভাবে কাজ করে যাবে। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে ভাবা সম্ভব না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়কার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংকস), বায়োটেকনোলজির ধারনা সর্বোচ্চ বিস্তৃতি এবং প্রতিটা ক্ষেত্রে এর প্রায়োগিক মাত্রা ব্যপকভাবে প্রসার পাবে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের সময়টায়।
এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা ধরা যাক। সব ধরনের স্মার্ট মেশিনের সাথে এআই সম্প্রিক্ত থাকবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব ধরনের সহজ কিংবা জটিল কাজ সম্পাদিত হবে। এখন পর্যন্ত যেসব কাজ মানব বুদ্ধিমত্তা ছাড়া করা সম্ভব না বা করতে হচ্ছে পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে এআইয়ের প্রসারে তা রোজকার সাধারণ ঘটনার মতই মনে হবে। অটোমেশন কারখানার সবগুলো মেশিন এআই সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে। এতে বাঁচবে শ্রম খরচ, কমবে মানবিক ক্রুটি। একাধিক কাজ যখন একটি যন্ত্র করতে পারবে তখন খরচ নিয়েও আর ভাবতে হবেনা।
রোবটিকস দূও নিরাপত্তা, কারখানার বিপদজনক কাজ,স্থাপনার শ্রমিক কিংবা স্রেফ নিয়াপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থালি কাজ সব কাজই করতে শুরু করবে রোবট। মানুষকে তখন অবসর সময়ে নিমগ্ন থাকতে কেবলমাত্র একটি রোবটেরই অপেক্ষা!
ইন্টারনেট অব থিংকস বা আইওটি প্রসঙ্গে বলা যায়, এটি এমন এক ধরনের প্রযুক্তি যা আপনার বাসার সকল আসবাব বা যেকোন ধরনের বস্তুর সাথে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের সংযুক্তি থাকবে। তখন আপনাকে আর প্রতিদিনকার করণীয় , প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবতে হবেনা। আপনার বিদ্যুতের বিল দেয়া নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা, বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাবে আপনার স্মার্টফোনে, বাসায় কি বাজার নেই তা জানিয়ে দেবে ফ্রিজ! আপনার শরীরে কি পুষ্টি উপাদান বাকি তাও জানিয়ে দেবে আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিন!
প্রযুক্তিবিদ ম্যাকিন্স বিশ্বাস করেন, ২০৫৫ সালের মধ্যে বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেক কাজ অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে।
মূলত স্মার্ট প্রযুক্তির সব ধরনের ধারনাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব থেকে আসে কিন্তু পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য থাকবে নীতিগত দিক দিয়ে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যেখানে প্রযুক্তির একচেটিয়া ব্যবহারে আগ্রহী , পঞ্চম শিল্প বিপ্লব তখন প্রযুক্তি এবং মানুষকে পাশাপাশি রেখে উন্নত পৃথিবীর কথা ভাবছে। পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের উদ্দেশ্যই হবে মানুষকে প্রযুক্তির জন্যে না করে, প্রযুক্তিকে মানুষের জন্যে করা।
প্রযুক্তিবিদ জেনপ্যাক্ট বিশ্বাস করে যে, পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের সময়টায় মানুষ এবং মেশিন কর্মক্ষেত্রে একত্রে সহবস্থান করবে এবং ক্রমশ প্রকৃতির কাছেই ফিরে আসবে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, পঞ্চম শিল্প বিপ্লব কিভাবে প্রকৃতি এবং প্রযুক্তির সহবস্থান নিশ্চিত করবে?
পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে, বায়োডিগ্রেডেবল টেকনোলজির ব্যবহার। এটি এখনো অনুমিত ধারনা মাত্র। ভাবা হচ্ছে, পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে বায়োডিগ্রেডেবল টেকনোলজির ব্যবহারই প্রযুক্তিকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। প্লাস্টিক পণ্যের কথা ধরা যাক। বর্তমান পৃথিবীতে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসে অন্যতম ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক। মাটিতে, জলাশয়ে, বিশাল আকারে প্লাস্টিকের স্তুপ। প্লাস্টিক পণ্যের আগ্রাসনে জীববৈচিত্র হুমকির সম্মুখে। ব্যাপারটা যদি এমন হয়, প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে এমন সব টেকনোলজির মাধ্যমে যা ব্যবহারের পর প্লাস্টিক পণ্যকে মাটির সাথে, পানির সাথে জৈব উপাদান হিসেবে মিশিয়ে দিচ্ছে, তাহলে প্লাস্টিকের ব্যবহার মানুষকে আর ভাবাবে না।
পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে এমন সব টেকনোলজির কথাই ভাবা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা টেকনোলজি ব্যবহার করে নিজেদের উপকার করেছি, প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছি। কিন্তু পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে যেসব টেকনোলজি আসবে বা যেসব টেকনোলজির কথা ভাবা হচ্ছে তা হবে বায়োডিগ্রেডেবল। অর্থাৎ প্রযুক্তি থেকে মানুষ উপকৃত হবে এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবেনা।
প্রতিটা শিল্প বিপ্লবই মানুষের মঙ্গল সাধনের পাশাপাশি কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসে। গবেষকরা পঞ্চম শিল্প বিপ্লব নিয়ে যেসব আশাবাদের কথা বলছেন এবং ভাবছেন তা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, নীতিশাস্ত্র কিভাবে নির্ধারিত হবে, কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নির্ভর করবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিপরীতমুখী প্রভাব এবং সময়ের উপর। পঞ্চম শিল্প বিপ্লব এখনো যেহেতু বর্তমানের প্রেক্ষিতে অনুমিত ধারনা মাত্র, সেক্ষেত্রে যেকোন কিছুই ঘটতে পারে।
তবে আমরা পঞ্চম শিল্প বিপ্লবে প্রযুক্তির ভালো অংশটুকু গ্রহণ এবং ক্ষতিকর অংশটা কাটিয়ে যেতে চাই।
মেহেদী হাসান
৫০ ব্যাচ, সিএসই ডিপার্টমেন্ট
0 Comments